Thursday 19 April 2018

স্নায়ুর জালে

অরিজিৎ ও পারমিতা, উত্তর কলকাতার মধ্যবিত্ত বাঙালি দম্পতি। দোতলার বাড়িতে সাজানো গোছানো সংসার। দিন কেটে যায় সচ্ছলতার ডানায় ভর করে। সুখ আছে, তবু যেন দুজনের মনে শান্তি নেই। একমাত্র সন্তান ধ্রবজ্যোতির বয়স সাড়ে তিন বছর। অন্য আর চার পাঁচটা সমবয়সীদের থেকে যেন বড্ড আলাদা। কোথায় এই সময়টা ধ্রুবজ্যোতি মেল্ ট্রেনের মতো ছুটবে, চড়াইপাখির মতো দুরন্ত পায় সারা বাড়ি তোলপাড় করবে অথচ কোনো এক অলৌকিক  জাদুবলে ধ্রুবজ্যোতি যেন ভীষণরকম শান্ত। তাতে অবশ্য কোনো সমস্যা ছিল না কিন্তু ছেলের যেন কোনো কিছুতেই কোনো স্পৃহা নেই। ডাকলে সাড়া দেয় না, খেলাধুলার প্রতি বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই, সারাক্ষন শুধু বারান্দার ধারে বসে সমানে কাগজ ছিঁড়তে থাকে। কোনো কথার উত্তর দেয় না ঠিকমতো, বন্ধুবান্ধবে আগ্রহ নেই তবে হঠাৎ করে কোনো কোনো বায়না ধরলে তা একনাগাড়ে বলতে থাকে। কোনোরকম বারণ বা শাসন গ্রাহ্য করে না। সাতপাঁচ ভেবে একজন নামকরা শিশুবিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিলেন অরিজিৎ ও পারমিতা। সমস্তটা দেখে তিনি বললেন ধ্রবজ্যোতি এস্পারগার্স সিন্ড্রোম অর্থাৎ অটিজমে আক্রান্ত। এখন থেকেই তার চিকিৎসার প্রয়োজন। অরিজিৎ ও পারমিতার মাথায় যেন বাজ পড়ল। এই গল্প বলার আগে আসুন জেনে নিই কি এই রোগ আর এর হাত থেকে নিস্তার পাবার উপায় কি। 


অটিজম কি ?
অটিজম সোসাইটি অফ আমেরিকার মতে এটি একটি জটিল স্নায়বিক রোগ যা মস্তিষ্কের অক্ষমতার কারণে হয়ে থাকে। এর সরাসরি প্রভাব পড়ে সাধারণ কথাবার্তায় এবং ব্যবহারে। ইন্ডিয়ান স্কেল এসেসমেন্ট অফ অটিজম - এর মতে ভারতবর্ষে প্রায় ২০ লক্ষ শিশু এই রোগের শিকার। বিশেষজ্ঞরা বলছেন প্রতি ৬৮ জন শিশুতে ১ জন শিশুর এই রোগ হয়। সর্বোপরি একটা আশ্চর্য তথ্য দিই। সারা বিশ্ব জুড়ে ৭ কোটি মানুষ রয়েছেন যাঁদের অটিজম আছে। তবে বিস্ময়ের ব্যাপার হল এঁদের মধ্যে ১ কোটি মানুষ হলেন ভারতীয়।

এই রোগের কারণ কি ? 
নিয়মিত গবেষণার ফলে কিছু কারণ চিহ্নিত করা যায়। যেমন -

# জিনগত বিরল সমস্যা, পরিবেশগত চাপ, গর্ভকালীন অবস্থায় পিতামাতার বয়স, গর্ভাবস্থায় মায়ের কোনো রোগ, জন্মের সময় শিশুর মস্তিষ্কে অপর্যাপ্ত অক্সিজেন প্রবাহ ইত্যাদি।
# এছাড়া মস্তিষ্কের গঠন ও কার্যক্ষমতায় অস্বাভাবিকতার দরুণও অটিজম হতে পারে।

এই রোগ কি একই রকমের হয় ?
একদমই না। এই রোগের বিভিন্ন প্রকার আছে এবং প্রকারগত সমস্যাও একেবারেই আলাদা। সুতরাং শিশুটির কোন অটিজম হয়েছে সে ব্যাপারে জেনে রাখা অত্যন্ত জরুরি।

# এস্পারগার্স সিন্ড্রোম - এই রোগে সাধারণত কোনো বস্তু বা বিষয়ের ওপর সাংঘাতিক আকর্ষণ থাকে। একই কাজ বারেবারে করার একটা প্রবণতা থাকে। এই রোগে আক্রান্ত শিশুরা স্বাভাবিক গড় বা গড়ের থেকে বেশি বুদ্ধিমান হয়। সেই কারণে একে হাই - ফাঙ্কশনিং অটিজমও বলা হয়।

# পারভেসিভ ডেভেলপ্মেন্টাল ডিসর্ডার -  সামাজিক মেলামেশা এবং কথা বলার ক্ষেত্রে যথেষ্ট সমস্যা হয়। এস্পারগার্স সিন্ড্রোমের তুলনায় আচরণগত সমস্যা কম।

# অটিস্টিক ডিসর্ডার - উপরোক্ত দুই প্রকারের তুলনায় এটি অত্যন্ত জটিল। এক্ষেত্রে সামাজিকতা ও কথাবলায় সমস্যা তো আছেই তাছাড়া মানসিক প্রতিবন্ধকতাও হতে পারে।

কিভাবে বুঝবেন বা উপসর্গ কি ?
জেনেসিস হাসপাতালের শিশু বিভাগের একজন স্বনামধন্য চিকিৎসক বলছেন যে সামাজিক ভাবে এই রোগ নিয়ে একটা সমস্যা আছে। মানুষকে বুঝতে হবে যে এই রোগ যদি প্রাথমিক ভাবে নির্ণয় করা যায় এবং শিশুদের পর্যাপ্ত সাহায্য করা যায় তাহলে সেই শিশুটিও অন্যদের মতো বেড়ে উঠবে। সমাজে তারও অবদান থাকবে এবং পাশাপাশি অন্যের ওপরেও নির্ভরশীল হতে হবে না। এই রোগ নির্ণয়ের কিছু সহজ পন্থা আছে, যেমন -

# শিশুটির যদি খেলনার প্রতি কোনো আকর্ষণ না থাকে
# ডাকলে যদি সাড়া না দেয়
# যদি নিজের খেয়ালেই ব্যস্ত থাকে
# একই কথা বারবার বলতে থাকে
# কথাবলার সময় যদি সরাসরি চোখের দিকে না তাকায় অথবা
# অন্যদের সাথে মেলামেশায় সমস্যা হয় তাহলে
একজন শিশু বিশেষজ্ঞের সাথে অবিলম্বে যোগাযোগ করতে হবে। অনেক সময় দেখা গেছে যে বাবা মায়েরা তাদের সন্তানের পাঁচ বছর বয়েসে ডাক্তারের কাছে নিয়ে আসেন। কিন্তু এক্ষেত্রে একেবারে প্রথম দিকে অর্থাৎ দু আড়াই বছর বয়েসেই ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করাই উচিত। তাতে করে প্রাথমিক ভাবেই শিশুটির চিকিৎসা শুরু হবে এবং মনোবিজ্ঞানীদের সাহায্যে বয়সচিত কাজের সাথেও পরিচিত হতে পারবে। যার দরুণ সুফল পাওয়া যাবে তাড়াতাড়ি। জেনে রাখবেন, বয়েস বেড়ে গেলে বিভিন্ন কাজের সাথে খাপ খাওয়াতে অসুবিধে হবে।

এক্ষেত্রে কি করণীয় ?
# বাবা মার কার্যকরী ভূমিকা -  বাবা মাকে ভীষণভাবে সহানুভূতিশীল হতে হবে এবং সমস্ত ক্ষেত্রে ধৈর্য ধরতে হবে।
# সুসম্পর্ক স্থাপন - সন্তানের সাথে বাবা মার অত্যন্ত স্নেহপ্রবণ সম্পর্ক হতে হবে। সন্তানের পড়াশোনা এবং সঠিক শিক্ষার ক্ষেত্রে বিশেষ নজর দিতে হবে।
# বিশেষজ্ঞর মতামত - সর্বপ্রথম একজন শিশু বিশেষজ্ঞর পরামর্শ ভীষণ প্রয়োজন। তাঁর মতামত অনুযায়ী চিকিৎসা পদ্ধতি মেনে চলাই বাঞ্ছনীয়। 
# সংশ্লিষ্ট সংস্থার সাথে যোগাযোগ - কিছু সংস্থা আছে যারা অত্যন্ত যত্নসহকারে এই শিশুদের পড়াশোনা ও অন্যান্য বিষয়ের দায়িত্ব পালন করেন। তাদের সাথে যোগাযোগ করে বিভিন্ন ট্রেনিং, থেরাপি ও এক্টিভিটির মাধ্যমে শিশুটির সর্বাঙ্গীন উন্নতি সাধন করুন। এক্ষেত্রে বাবা মায়েদেরও বিশেষ প্রশিক্ষণ নিতে হয়। নিম্নলিখিত লিঙ্কগুলিতে যোগাযোগ করতে পারেন।
http://autismsupport.in/helpline-region/west-bengal/#s=1
http://www.pradipautism.org/#
http://shruti.co.in
http://motherandchildschool.com/index.html

কয়েক বছর ধরে, একটি অটিজম সেন্টারের যোগ্য সহায়তায় ও নিয়মিত ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে ধ্রুবজ্যোতি ধীরে ধীরে তার প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে উঠছে। অরিজিৎ ও পারমিতার মুখে এখন স্বস্তির ছাপ। তাঁদের একমাত্র সন্তান নতুন করে পড়াশোনা শুরু করেছে। সন্ধ্যের দিকে সে নিয়মিত বইখাতা খুলে বসে। কয়েকজন বন্ধুবান্ধব হওয়াতে ক্রিকেটের প্রতি তার একটা বিশেষ আগ্রহ জন্মেছে। ভারতবর্ষের বহু বাড়িতে এমন ধ্রুবজ্যোতিরা অনেকেই রয়েছে। এমন ভাবার কিন্তু কোনো কারণ নেই যে তারা সময়পোযোগী হয়ে উঠতে পারবে না। বরং সঠিক দিশা পেলে নিজ নিজ বিষয়ে তারা যথেষ্ট যোগ্যতা প্রমান করতে পারে যার নজির কিন্তু প্রচুর রয়েছে। প্রয়োজন একটু দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টানোর, একটু সহনীয় মনোভাবের........ মনে রাখতে হবে তারাও এ পৃথিবীর সন্তান।

#Autism #Worldautismday #autisticchildren #neurology #neurologicaldisorder #AsPrescribed #GenesisHospitalKolkata

No comments:

Post a Comment