Tuesday 30 January 2018

তিল থেকে তাল

কথায় বলে বিউটি স্পটের কদরই আলাদা। বিশেষ করে মহিলাদের ক্ষেত্রে একপ্রকার আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু বলা যেতে পারে। মুখে যাদের বিউটি স্পট আছে তারা যে রাস্তাঘাটে অতিরিক্ত মনোযোগ পেয়ে থাকেন এ হয়ত না বললেও চলবে। ভুবনমোহিনী হাসির অন্তরালে যার ভূমিকা সবচেয়ে বেশি তার দিকে বরং আরেকটু লক্ষ্য রাখুন। খেয়াল করে দেখুন তো এই বিউটি স্পটের বিউটি চিরকাল একইরকম থাকছে কিনা ? অর্থাৎ যে স্পট বা  তিলটি সৌন্দর্যের মূল উপাদান সেইটি কোনোরকম আকারে পরিবর্তন হল, নাকি তার বর্ণের কোনোরকম বিসদৃশ ঘটল ! তা যদি হয়ে থাকে তাহলে চিকিৎসকের কাছে ছুটে যান এক্ষুনি। মেলানোমা নামক ত্মকের একটি ভয়ানক ক্যান্সার হতে পারে। এই রোগের কথা আগে না শুনে থাকলে, আজই জেনে নিন এর হাল হকিকত।  

মেলানোমা কি ?
খুব প্রচলিত না হলেও ত্মকের এই ক্যান্সারটি অত্যন্ত মারাত্মক কারণ এটি সহজেই ছড়িয়ে পড়ে।সূর্যের আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মির প্রভাবে কিছু জেনেটিক সমস্যা তৈরী হয়। যার ফলে ত্মকের কোষগুলি দ্রুত সংখ্যাবৃদ্ধি করে এবং ম্যালিগন্যান্ট টিউমারে পরিণত হয়। এই টিউমারগুলি তৈরী হয় এপিডার্মিসের বেসাল লেয়ারে। ত্মকের যে কোনো জায়গায় হতে পারে এই রোগ। মেলানোমা কতকটা তিলের মতো দেখতে হয়। কিছু ক্ষেত্রে আবার তিল থেকেই শুরু হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মেলানোমা কালো বা বাদামী রঙের হয়। আবার কখনো কখনো গোলাপী, লাল, বেগুনি বা সাদা রঙেরও হতে পারে। প্রধানত ইউভি (UV) রশ্মির তীব্রতার কারণেই ত্মকে মেলানোমা হয়। 

তবে কি আশার আলো একেবারেই নেই ? হ্যাঁ আছে। প্রাথমিক পর্যায়ে যদি মেলানোমা ধরা পড়ে এবং চিকিৎসা হয় তাহলে প্রায়ই সেড়ে যায়। তা যদি না হয় তাহলে এই ক্যান্সার শরীরের অন্যান্য অঙ্গ প্রত্যঙ্গে ছড়িয়ে পড়তে পারে এবং মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে। 

কত রকমের হয় এই রোগ ?
মেলানোমা সাধারণত চার রকমের হয়। 
#  সুপার ফিসিয়াল স্প্রেডিং মেলানোমা - এটি বেশ প্রচলিত। সাধারণত বুক, পেট, পিঠ বা হাতে পায়ে দেখা যায়।

# নোডিউলার মেলানোমা - বুক, পিঠ, মাথা বা গলার দিকে হয়। অপেক্ষাকৃত দ্রুত বৃদ্ধি ঘটে এই রোগের এবং ধীরে ধীরে লাল হতে থাকে। 

# লেন্টিগো ম্যালাইনা মেলানোমা - বয়স্কদের ক্ষেত্রে এর প্রবণতা দেখা যায়। বিশেষ করে শরীরের সেই সমস্ত জায়গাতে হয় যা বহু বছর ধরে সূর্যের রশ্মিতে উন্মুক্ত থাকে। প্রথমে একটা দাগের মতো হয়, সময়ের সাথে ধীরে ধীরে তা বাড়তে থাকে। তুলনামূলক ভাবে এটি কম বিপজ্জনক।

# এক্রাল লেন্টিজিনাস মেলানোমা - এই রোগটি বিরল। সাধারণত এটি দেখা যায় হাতের চেটোয়, গোড়ালির নিচে অথবা নখের তলায়। এর সাথে ত্মকের বর্ণ বা সূর্যের রশ্মির কোনো সম্পর্ক নেই।

এই রোগ হওয়ার কারণ কি ?
কোনো একটি নির্দিষ্ট ধরণের ত্মকে মেলানোমা হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। নিম্নলিখিত কারণের ফলে এই রোগ হতে পারে। 
# ছোট ছোট প্যাচ হওয়া বা সূর্য রশ্মির কারণে সেই প্যাচ গাঢ় হওয়া। 
# প্রচুর তিল হওয়া 
# সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরণের তিল হওয়া 
# ছোট ছোট বাদামী রঙের স্পট বা বয়সজনিত কোনো স্পট দেখা দেওয়া 
# এমন ত্মক যা সহজেই রোদে পুড়ে যায়
# অতিরিক্ত সময় ধরে সূর্যের রশ্মিতে উন্মুক্ত থাকা  
# পরিবারের কোনো সদস্যের মেলানোমা হওয়া বা 
# যদি কোনো অঙ্গ প্রতিস্থাপন হয়ে থাকে

এর উপসর্গ কি কি ?
অন্যান্য ক্যান্সারের মতোই মেলানোমার প্রাথমিক স্টেজ শনাক্ত করা মুশকিল হতে পারে। তবে খেয়াল রাখতে হবে ত্মকে কোনোরকম পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে কিনা। যেমন - 
# নতুন কোনো স্পট বা তিল হওয়া অথবা পুরোনো তিলের বর্ণ বা আকারে কোনো পরিবর্তন 
# ত্মকের কোনো সমস্যা সহজে ঠিক না হওয়া  
# কোনো স্পটে ব্যাথা হওয়া বা রক্তক্ষরণ হওয়া 
# কোনো স্পট অতিরিক্ত উজ্জ্বল, মসৃণ বা ম্লান হওয়া, অথবা 
# কোনো অদ্ভুত দর্শন শক্ত লাল পিণ্ড যার থেকে রক্তক্ষরণ হচ্ছে 

কিভাবে বুঝবেন ?
এবিসিডিই (ABCDE) টেস্টের মাধ্যমে মেলানোমার উপস্থিতি টের পাওয়া যায়। নিচে বিশদে দেওয়া হল। 
# এসিমেট্রিক - সাধারণ তিল, গোল বা সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। ক্যান্সারাস তিল কিন্তু গোল বা সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে না। অর্থাৎ তিলটির দুদিক একইরকম দেখতে নয়। 
# বর্ডার - তুমলমূলক ভাবে অমসৃণ বা ঝাপসা হবে।  
# কালার - বিভিন্ন বর্ণের হতে পারে, যেমন - কালো, বাদামী, সাদা বা নীল। 
# ডায়ামিটার - তিলের আকারে পরিবর্তন বা সাধারণ তিলের থেকে বড় হলে ক্যান্সারের লক্ষণ হতে পারে। 
# ইভলভিং - কয়েক সপ্তাহ বা মাসের মধ্যেই যদি তিলের চেহারায় পরিবর্তন আসে তাহলেও ক্যান্সারের লক্ষণ হতে পারে। 

চিকিৎসার উপায় 
অন্যান্য ক্যান্সারের তুলনায় এর চিকিৎসা খানিকটা সহজ কারণ এর সম্পূর্ণ অপসারণ সম্ভব। মেলানোমার অত্যন্ত প্রচলিত চিকিৎসা হল সার্জারি। অস্ত্রপচারের মাধ্যমে ক্ষতস্থান ও চারপাশের টিস্যু অপসারণ করা হয়। যদি ত্মকের অনেকটা জায়গা জুড়ে হয় তাহলে স্কিন গ্রাফটিংয়ের মাধ্যমে নির্মূল করা হয়। এছাড়া স্কিন ক্যান্সারের অন্যান্য সাধারণ চিকিৎসা পদ্ধতিগুলি হল - কেমোথেরাপি এবং বায়োলজিক্যাল থেরাপি। বিরল ক্ষেত্রে ফোটোডায়নামিক থেরাপিও করা হয়। 

সুতরাং মেলানোমার জন্য দরজা খোলা না রেখে আমাদের প্রতিরোধের দিকে মন দেওয়াটাই বেশি প্রয়োজন। অতিরিক্ত রোদ বা সূর্যের তাপ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে চলুন। বলাই বাহুল্য ব্যাগে সানস্ক্রিন রাখতে হবে এবং সরাসরি সূর্যের আলো থেকে শিশুদের দূরে রাখুন। মেলানোমার কবল থেকে বাঁচতে নিজেকেই প্রাথমিক ধাপটা নিতে হবে, জানবেন, বিপদ কিন্তু ওত পেতেই আছে। তাই আগের থেকেই সাবধান হন।

#melanoma #skincancer #GenesisHospitalKolkata #AsPrescribed #bengalihealtharticle #medicalarticle #health 

Friday 12 January 2018

দিনের শেষে ঘুমের দেশে

(Audio File)
https://soundcloud.com/user-298724335/fz5bc3sdjgnc 


ঘুম বড় আশ্চর্য জিনিস। পেলে একরকম না পেলে আরেকরকম। যখন তখন ঘুমিয়ে পড়াও যেমন ঠিক নয় তেমনি ঘুমকে অবজ্ঞা করাও মোটে উচিত নয়। ট্রামে, বাসে বা ট্রেনে যদি আপনি মখমলি কাঁধ পেলেই চোখ বোজার সুযোগ খোঁজেন তাহলে বলতে হবে আপনি ঘুমের অভাবে ভুগছেন অথবা ঐটে আপনার ভীষণ রকম বদভ্যেস। সেটা যদি না হয় তাহলে চট করে পড়ে ফেলুন ঘুমের অভাবে কি কি হতে পারে। 

ঘুমের অভাবে কি হতে পারে ?
ঘুমের অভাবে নানান রকম সমস্যা তৈরী হয়। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে সেসব সমস্যা জটিলতর হতে থাকে অচিরেই। এক্ষেত্রে প্রথমেই যার কথা বলতে হয় তা হল স্মৃতি। ভীষণ রকম স্মৃতিজনিত সমস্যা হতে পারে। যাঁরা গান ভালোবাসেন তাঁদের, 'তোমার গীতি জাগালো স্মৃতি' - রবিঠাকুরের এই গানটি আর নাও মনে আসতে পারে। মুচকি হেসে ভাবছেন, 'যাহ ! রবিঠাকুর ভুলে যাব ! তাই আবার কখনো হয় নাকি' ! তাহলে একটি সরল, ছোট্ট ব্যাখ্যা দিই। আসন্ন বিপদটা বুঝতে সুবিধে হবে আপনার। খুব সহজ ভাষায় বলতে গেলে আপনার ইমেল্ ইনবক্সের মতো মস্তিষ্কেরও একটি স্মৃতির ইনবক্স থাকে। ঠিকঠাক ঘুম না হলে এই ইনবক্সটি আপনা আপনিই বন্ধ বা শাট ডাউন হয়ে যায়। যার ফলে নতুন করে কোনোরকম স্মৃতি তৈরী হতে পারে না। আপনার স্মৃতিবিলোপ হতে থাকে খুব তাড়াতাড়ি। দাঁড়ান, এখানেই শেষ নয়।  

এছাড়া আরও একটি সমস্যা আছে। ঘুমের অভাবে একটি বিষাক্ত প্রোটিন তৈরী হয় যার নাম হল 'বিটা এমিলয়েড'। এই প্রোটিন তৈরীর ফলে আপনার মারাত্মক রকমের স্মৃতি সংশয় হতে পারে, ডাক্তারি পরিভাষায় যার নাম - আলঝেইমার্স ডিজিজ। ঘুমোনোর সময় আপনার মস্তিষ্কে একটি নিকাশী ব্যবস্থা সচল হয়ে ওঠে। যার মাধ্যমে এই 'বিটা এমিলয়েড' ধুয়ে সাফ হয়ে বেরিয়ে যায়। সুতরাং ঘুমের অভাব কিন্তু অজান্তেই আপনার মস্তিষ্কে তৈরী করবে এই আলঝেইমার্স প্রোটিন। যত বেশি মাত্রায় এই ক্ষতিকারক প্রোটিন তৈরী হবে ততটাই দ্রুত আপনি স্মৃতিভ্রংশ হবেন। "ম্যায় কাঁহা হুঁ" ? এই ধরণের প্রশ্ন আপনার মুখ থেকে বেরিয়ে আসাটা কিন্তু অস্বাভাবিক নয়। সুতরাং 'ঘুমিয়ে কি কেউ বড়লোক হতে পেরেছে' ? - এই বেদবাক্যে যদি আপনি বিশ্বাসী হন তাহলে কোন কোন রোগকে আগাম পান সুপুরি দিয়ে নিমন্ত্রণ দিচ্ছেন তা একবার নিচের লেখায় চোখ বুলিয়ে নিলেই জানতে পারবেন।   

শরীরের ওপর কি কি প্রভাব পড়ে  ?
শরীরের ওপর এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী। যাঁরা ইচ্ছে করে রাত জাগেন বা অনিদ্রাজনিত সমস্যায় ভোগেন তাঁরা হয়ত জানেন না যে অজান্তেই আপনারা শরীরের মধ্যে ডেকে আনছেন অবাঞ্ছিত বিপদ। পরবর্তীকালে যে বিপদ আপনাদের প্রাণ সংশয়ের কারণ হয়ে উঠতে পারে। তখন হয়ত বড্ড বেশি দেরি হয়ে যাবে। তাই আগের থেকেই জেনে রাখুন নিম্নলিখিত বিপদের তালিকা এবং প্রয়োজনমত ব্যবস্থা নিন এখন থেকেই।

# প্রজনন প্রক্রিয়ায় এর যথেষ্ট প্রভাব পড়ে। যে সমস্ত পুরুষরা ৫ থেকে ৬ ঘন্টা ঘুমোন তাদের টেস্টোস্টেরনের মাত্রা তুলনামূলক ভাবে বেশ কম হয়। ঘুমের অভাবে কিন্তু তাদের পুরুষত্ব হ্রাস পাবার সম্ভাবনা সাংঘাতিক রকম বেশি। 

# রোগ প্রতিরোধের ক্ষেত্রেও এর প্রভাব মারাত্মক। যাঁরা ৪ থেকে ৫ ঘন্টা ঘুমোন তাঁদের এন্টি ক্যান্সার রোগ প্রতিরোধক কোষের সংখ্যা ৭০ শতাংশ হ্রাস পায়। এছাড়া অন্য আরও ক্যান্সারের ঝুঁকি থাকে প্রবল। যেমন অন্ত্রের ক্যান্সার, প্রস্টেট ক্যান্সার এবং স্তনের ক্যান্সার। সম্প্রতি হু (WHO), রাত্রিকালীন  শিফটের কাজগুলিকে ক্যান্সারের অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। 

# এছাড়া কার্ডিওভাসকুলার সিস্টেমের ওপরেও বিশেষ প্রভাব পড়ে। এখানে জেনে রাখা ভালো যে ঘুমোনোর সময়তেই আমরা কিন্তু রক্তচাপের ওষুধ সঞ্চয় করি। আশ্চর্য হচ্ছেন ? আমাদের হয়তো অনেকেরই এই সহজ তথ্যটি জানা নেই যে ঘুমোনোর সময় হৃদ কম্পন ধীরগতির হয় যার ফলে রক্তচাপ হ্রাস পায়। জানা গেছে যে ৬ঘন্টা বা তার কম সময়ে ঘুমের দরুন হার্ট এট্যাক বা স্ট্রোকের সম্ভাবনা থাকে ২০০ শতাংশ।  সুতরাং পরিমিত ঘুম, সুস্থ হৃদয়ের অন্যতম কারণ। 

বছরে দুবার প্রায় ১৬ কোটি মানুষের ওপর বিশ্বব্যাপী একটি পরীক্ষা করা হয় যার নাম হল ডেলাইট সেভিং টাইম। এই পরীক্ষায় দেখা গেছে যে একদিন এক ঘন্টা কম ঘুমোনোর ফলে তার পরের দিনে ২৪ শতাংশ হার্ট এট্যাক বেড়েছে। এমতাবস্থায় খুব স্বাভাবিকভাবে একটি প্রশ্ন উঠে আসে। 

ঘুম ছাড়া কতক্ষন পর্যন্ত আমাদের মস্তিস্ক সঠিক ভাবে কাজ করতে পারে ?
উত্তর হল - ১৬ ঘন্টা। তারপরেই মানসিক ও শারীরিক অবনতি ঘটে। কতকটা গাড়ির স্টিয়ারিঙ ধরে  নেশাগ্রস্ত অবস্থায় চালানোর মতো। অতএব জেগে থাকার ক্ষতি মেরামতির জন্য অন্তত পক্ষে ৮ ঘন্টার ঘুম অতি আবশ্যক। তাই এরপরেও যদি আপনার মনে হয় রাত জেগে আরও কিছুক্ষন লুডো খেলে নি, যা আপনি খেলতেই পারেন কিন্তু পরের দিনে আপনাকে না ছক্কা পুটের মাশুল গুনতে হয় সে ব্যাপারে কিন্তু অবশ্যই খেয়াল রাখবেন। বাকি আপনি দিনের শেষে ঘুমের দেশে যাবেন না অন্য কোথাও সে আপনার একান্তই ব্যক্তিগত।

courtesy : Prof. Matthew Walker, Neuroscience and Psychology, University of California, Berkeley

#sleepdisorders #sleepproblems #lackofsleep #AsPrescribed #GenesisHospitalKolkata


Saturday 6 January 2018

হাত জড়ালেই বন্ধু


আজকের দুপুরটা সম্পূর্ণ অন্য রকম। সারা বছরের মুহূর্তগুলো জমাট বাঁধা হয়ে আছে এক অমূল্য ক্ষণে। যে ক্ষণের অপেক্ষায় সৌভিক দিন গুনেছে সময়ের পর সময়ের হাত ধরে। অবশেষে পৃথা সায় দিয়েছে। সায় দিয়েছে কিছু মুহূর্ত একসাথে কাটাবার, কিছু উষ্ণতা একসাথে ভাগ করে নেবার। দুদিন আগে টেলিফোনে যখন সৌভিক ডায়াল করেছে পৃথার নাম্বারটা তখন পৃথা জানতই না সৌভিক তাকে দেখা করার কথা বলবে। জানত না গঙ্গার ধারে আপাত নিরিবিলি, ছিমছাম এক রেস্তরাঁর বুকে আঁকা হবে কত দিনবদলের স্বপ্ন। তাই আধঘন্টা আগেই পৌঁছে গিয়েছিল সৌভিক। পৃথা অবশ্য দেরি করেনি খুব বেশি। যথাসময় পৌঁছে টিউশন ক্লাসের ব্যাচমেট সৌভিকের চোখে চোখ রেখেছিল। ইশারায় জিজ্ঞেস করেছিল এমন তলবের কারণ। যদিও মনে মনে পৃথা জানত কারণটা, তবুও নিজের কানে শোনার লোভটুকু বিসর্জন দিতে পারেনি সে। পৃথার সমস্ত পছন্দসই খাবার অর্ডার করে অনুরাগের গল্পে মেতে উঠেছিল দুজনে। 

সবটাই নিজস্ব নিয়মে চলছিল। কিন্তু তীরে এসে যে তরী ডোবার উপক্রম হবে একথা বোধহয় একমাত্র ঈশ্বরই জানতেন। সৌভিক হয়ত একটু তাড়াহুড়ো করে ফেলেছিল। খাবার শেষ হওয়ার আগেই বলে ফেলেছিল তার হৃদয়ের গোপন আর্তিগুলো। অকপটে ছুঁয়ে ফেলেছিল ভালোবাসার স্পন্দন। অকস্মাৎ বিষম খেয়েছিল পৃথা। আর তাতেই কাল হল। মাংসের টুকরো গলায় আটকে দমবন্ধ হবার উপক্রম হল প্রায়। দুপুরের নৈকট্য টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে গেল জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষনে। দম আঁটকে অচৈতন্য হবার মুহূর্তে সৌভিক ধরে ফেলে পৃথাকে। বায়োলজির সুযোগ্য ছাত্র সৌভিক, হেমলিচ ম্যানুয়েভারের বিশেষ কায়দায় পৃথার পেটে চাপ দিয়ে গলা থেকে বের করে আনল মাংসের টুকরোটা। এক লহমা দম নিয়ে পৃথা জাপটে ধরেছিল সৌভিককে। আসন্ন মৃত্যুর কিনারা থেকে ফিরে এসে  থরথর করে কেঁপে উঠেছিল সে। সে যাত্রা জোর বেঁচেছিল পৃথা আর হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছিল রেস্তোরাঁর বাকি লোকজন। এই হেমলিচ ম্যানুয়েভারের বিশেষ কায়দাটি কি, সেটা আসুন একটু জেনে নিই।   

হেমলিচ ম্যানুয়েভার কি ?
হেমলিচ ম্যানুয়েভার হল একটি প্রাথমিক চিকিৎসা পদ্ধতি। শ্বাসনালীতে আটকে থাকা কোনো খাবারের টুকরো বা অন্য কোনো বস্তু বের করার ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়। ১৯৭৪ সালে ডঃ হেনরী হেমলিচ এই পদ্ধতিটি প্রথম প্রদর্শন করেন। ওনার নামানুসারেই এই পদ্ধতির প্রচলন শুরু হয়।জরুরী অবস্থায় এই পদ্ধতিটি কিভাবে প্রয়োগ করবেন তা জানতে হলে নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলি অনুসরণ করুন।


চোকড হবার সময় কি করবেন ?
যে ব্যক্তিটি চোকড হচ্ছেন তাঁর কথা বলা বা শ্বাস নেওয়ার ক্ষেত্রে ভীষণ সমস্যা হতে পারে। এই সময় যা করতে হবে তা হল -
# ব্যক্তিটির পিছন দিক দিয়ে কোমরের চারপাশে দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরুন।
# একহাতে মুঠো বন্ধ করে, আপনার বুড়ো আঙুলের দিকটা ব্যক্তিটির পাঁজরের নিচে অর্থাৎ পেটের ওপরের দিকে চেপে ধরুন।
# অন্য হাত দিয়ে সেই মুঠো চেপে ব্যক্তির পেটের উপরিভাগে জোরে চাপ দিন। কিন্তু খেয়াল রাখবেন এই চাপ যেন পাঁজরের ওপর কখনই না পড়ে।
# এই পদ্ধতিটি বারে বারে করতে থাকুন, যতক্ষণ না খাবারের টুকরো বা বস্তুটি মুখ দিয়ে বেরিয়ে না আসে।
# মনে রাখবেন কখনোই যেন পিঠে চাপড় মারবেন না। তাতে কিন্তু হিতে বিপরীত হতে পারে।


যখন ব্যক্তিটি অচৈতন্য হয়ে পড়েছেন তখন কি করবেন ?
# প্রথমে তাকে চিৎ করে শোয়ান। 
# এরপর ব্যক্তিটির কোমরের দু দিকে হাঁটু মুড়ে বসুন।
# একটা হাতের ওপর আরেকটা হাত রেখে ব্যক্তিটির পেটের ওপর দিকে অর্থাৎ পাঁজরের নিচে চেপে ধরুন।
# তারপর দুহাত একই ভাবে রেখে দ্রুত চাপ দিতে থাকুন।
# বস্তুটি বের না হওয়া পর্যন্ত একই ভাবে করতে থাকুন। এক্ষেত্রেও পিঠে চাপড় মারতে যাবেন না কিন্তু।


শিশুদের ক্ষেত্রে কি করবেন ?
# শিশুটিকে শক্ত জমির ওপর শুইয়ে দিন। অথবা নিজের কোলে নিয়েও বসাতে পারেন।
# আপনার দুহাতের তর্জনী ও মধ্যমা এক সাথে শিশুটির পাঁজরের নিচে এবং নাভির ওপর রাখুন।
# এরপর ওই অবস্থায় দুহাতের আঙ্গুল দিয়ে একসাথে পেটের উপরিভাগে চাপ দিতে থাকুন।
# বস্তুটি বের না হওয়া পর্যন্ত এই পদ্ধতি অনুসরণ করতে থাকুন।
# তবে খুব সাবধানে করবেন, পাঁজরে যেন কোনোভাবেই চাপ না পড়ে।

নিজের ক্ষেত্রে হলে কি করবেন ? 
# এক হাতে মুঠো বন্ধ করে, মুঠোর বুড়ো আঙুলের দিকটা আপনার পাঁজরের নিচে অর্থাৎ পেটের ওপরের দিকে চেপে ধরুন।
# তারপর অপর হাত দিয়ে সেই মুঠো চেপে পেটের উপরিভাগে জোরে চাপ দিন।
# বস্তুটি না বেরোনো অবধি এটি করতে থাকুন।
# এছাড়া আপনি কোনো চেয়ার, টেবিল বা শক্ত কিছুর ওপর ভর দিয়ে ঝুঁকে দাঁড়াতে পারেন।
# আপনার পেটের উপরিভাগ দিয়ে সেই শক্ত বস্তুটির ওপর ক্রমাগত চাপ দিতে থাকুন। এক্ষেত্রেও বস্তুটি শ্বাসনালী থেকে না বেরোনো অবধি বারে বারে করুন। 

ওপরের যে কোনো ক্ষেত্রে যদি পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হয় তাহলে অবিলম্বে ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করতে হবে এটি আর বলার অপেক্ষা রাখে না। উপরোক্ত ঘটনায় সৌভিক অনন্য গিফ্ট পেয়েছিল পৃথার থেকে। কারণ, এমন আশ্চর্য প্রাথমিক চিকিৎসা পদ্ধতিতে পৃথা শুধু মোহিতই হয়নি, তার বন্ধুর হাত ধরে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তার পরে পরেই। তবে জীবনবিজ্ঞানের ছাত্র বা ছাত্রী আপনি যদি নাও হন তবুও নিকট আত্মীয়ের বিপদের সময় হাত বাড়ানোটাই কিন্তু উপযুক্ত বন্ধুত্বের পরিচয়। হেমলিচ ম্যানুয়েভার পদ্ধতির সামান্য কয়েকটি ধাপ মাত্র, শিখে রাখতে ক্ষতি তো কিছু নেই, কে জানে কখন কোথায় কিভাবে কাজে লাগে, তাই না ? 

#Heimlichmaneuver #abdominalthrust #bengalihealtharticle #firstaid #emergencytreatment  #AsPrescribed