Saturday 7 October 2017

গোপন কথাটি রবে না গোপনে....

ইদানীং অবনীবাবু ঘুম ভাঙলেই যেন আতঙ্কিত হয়ে পড়ছেন। দুচোখের পাতা খুললেই তাঁর চোখের কোণে জল আসার উপক্রম হয়। পায়ে পায়ে বাথরুমের দরজা খুলে কমোডের ওপর বসলেই তিনি প্রায় সর্ষেফুল দেখতে থাকেন চারিধারে। প্রথমদিকে ভয়ের চোটে বাথরুম যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন একেবারে। কিন্তু পেটের কামড় উপেক্ষা করবে এমন বীরপুঙ্গব আর যেই হোন না কেন অবনীবাবু অন্তত নন। আর তাই সমস্ত সাহস সঞ্চয় করে প্রত্যেক সকালবেলাতে তিনি কোনোমতে কষ্ট করে কমোডের ওপর বিরাজমান হতে থাকেন। কিন্তু সেও ক্ষনিকের। কিছুটা হওয়ার পরই অস্বস্তিতে উঠে চলে আসেন বারবার। কারণটা আর কিছুই নয়। ফুরফুরে দিনের শুরুতেই প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়ার মাহেন্দ্রক্ষণে তাঁর মলদ্বার দিয়ে রক্তক্ষরণ হতে থাকে। তিনি বিলক্ষণ বুঝতে পারেন যে তাঁর গুপ্তস্থানে কিঞ্চিৎ গোলযোগ দেখা দিয়েছে অথচ চরম সঙ্কোচের ফলে ভরসা করে বাড়ির কাউকে বলেও উঠতে পারছেন না। কারণ বললেই যদি কেউ বলে, 'কই দেখি' ? তাহলে তো আর তিনি লাজ লজ্জার মাথা খেয়ে কোনোকিছুই ঠিক দেখিয়ে উঠতে পারবেন না। তাই তিনি চুপচাপ ঠিক করলেন পাড়ার ডাক্তারকে গিয়ে একবার গোপনে দেখিয়ে নেবেন। চেম্বারে গিয়ে পাজামার দড়ি আলগা করে কামানের মতো পিছন তাক করে যখন ঝুঁকে দাঁড়ালেন তখন ডাক্তার গম্ভীর হয়ে বললেন, 'হুম, আপনার তো পাইলস হয়েছে মশাই'। একথায় অবনীবাবু প্রায় শুকনো মুখে জিজ্ঞেস করলেন, 'তাহলে' ?

এই তাহলে যে কি সেটা জানতে হলে বেশ কিছু জিনিস আগে জেনে রাখা প্রয়োজন। যেমন শুধু পাইলস নয়, গুপ্তস্থানে ফিশার বা ফিশ্চুলার মতোও কঠিন রোগ হতে পারে। সেগুলো কি, কেমন করে হয় আর তার কি প্রতিকার, আসুন জেনে নিই এক এক করে।  

পাইলসের সাতকাহন 
মলদ্বারের ভিতরে যে ছোট ছোট শিরাগুলি থাকে সেগুলি যখন বিভিন্ন কারণে স্ফীত হয় তখনই তাকে পাইলস বা অর্শ বলে। মূলতঃ কোষ্ঠকাঠিন্য, ডায়েরিয়া, ভারী ওজন তোলা, প্রেগন্যান্সি বা মলত্যাগে সমস্যার দরুন পাইলস হয়। তবে চিন্তার কিছু নেই, অনেকসময়ই পাইলস কিন্তু নিজে থেকেই সেরে যায়। অবশ্য সমস্যা জটিল হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া অত্যন্ত জরুরী। খুব কঠিন সমস্যা হলে ছোট্ট সার্জারিতেই রোগ নিরাময় হয়।  

পাইলসের উপসর্গ কি ?

সাধারণত পাইলসে কোনো যন্ত্রনা হয় না। মলদ্বারের চারপাশে অস্বস্তিকর সমস্যা হয়। প্রথম দিকে মলদ্বার থেকে রক্তপাত হয়। দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেণীর পাইলস থেকে কষ্ট অনুভূত হয়। বিশেষ করে চতুর্থ শ্রেণীতে পৌঁছলে রক্ত জমাট বেঁধে থ্রম্বোসিসের আকার ধারণ করে। সেক্ষেত্রে যথেষ্ট বেদনাদায়ক হয়।

এর চিকিৎসা কি ?
জেনেসিস হসপিটালের কর্ণধার ও বিখ্যাত শল্যচিকিৎসক ডঃ পূর্ণেন্দু রায় এই সমস্যার কিছু সহজ সমাধান দিয়েছেন। ডায়েট কন্ট্রোল করলে অনেকাংশেই এর থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। যেমন ফাইবার যুক্ত খাবার, ফল, শাকসবজি, ইত্যাদির ওপর জোর দেওয়া প্রয়োজন। প্রচুর পরিমানে জল খেতে হবে এবং ক্যাফিনের থেকে দূরে থাকতে হবে। মলত্যাগের সময় বেশি চাপ না দেওয়াই বাঞ্ছনীয়। শরীরের স্থূলতা কমিয়ে ফেলতে হবে এবং নিয়ম করে কিছু হালকা ব্যায়াম করলে এর সুফল পাওয়া যাবে। এছাড়া চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে কিছু মলম, ক্রীম বা স্টুল সফ্টনার ব্যবহার করলে অনেকটাই উপকার পাওয়া যায়।

এবার ফিশার 
মলদ্বার চিরে যাওয়া বা কেটে যাওয়াকে ফিশার বলে। এই চিরে যাওয়া জায়গায় অসম্ভব যন্ত্রনা হয় এবং মলত্যাগের সময় বা পরে রক্তপাত ঘটে। এর বিভিন্ন কারণগুলি হল কোষ্ঠকাঠিন্য, মলত্যাগে সমস্যা, শিশুর জন্ম দেওয়া, ডায়েরিয়া, ইনফেকশন বা অন্যান্য পেটের সমস্যা।  যে কোনো বয়েসেই এই রোগ হতে পারে। সাধারণত ফিশার নিজের থেকেই সেরে যায় তবুও একজন চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।

ফিশারের উপসর্গ কি ?
# চেরা জায়গার পাশে ছোট মাংসপিণ্ড হওয়া।
# মলত্যাগের সময় অসহ্য যন্ত্রনা।
# মলের সাথে রক্তপাত এবং মলদ্বারে জ্বলন।  

এর চিকিৎসা কি ?
সাধারণত অত্যাধিক ওষুধের প্রয়োজন পড়ে না। কিছু সহজ প্রতিকারের মাধ্যমে এই রোগের থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। যেমন প্রচুর পরিমানে জল, ফলমূল, সবজি খেতে হবে। নাইট্রোগ্লিসারিন মলম বা হাইড্রোকর্টিসোন ক্রীম ব্যবহার করলে বেশ উপকার পাওয়া যায়। এছাড়া সিটজ বাথ নিলে অনেকটাই অস্বস্তি কমে। এক গামলা ঈষদুষ্ণ জলে দিনে অন্তত দুবার কোমর অবধি ডুবিয়ে রাখলে অনেকটাই সুফল পাবেন। এর পরেও যদি সমস্যা হয় তাহলে একমাত্র চিকিৎসকই আপনার ভরসা।

সবশেষে ফিশ্চুলা 
ফিশ্চুলা হল একটি ছোট চ্যানেল বিশেষ, যা অন্ত্রের শেষভাগ ও মলদ্বারের চামড়ার মাঝামাঝি তৈরী হয়। এর মাধ্যমে রক্তপাত হয়, পুঁজ জমা হয় এবং কখনো কখনো মল বেরিয়ে আসে। ফিশ্চুলা যথেষ্ট বেদনাদায়ক এবং সার্জারি করেই এই রোগের নিরাময় ঘটে। ডঃ পূর্ণেন্দু রায় জানাচ্ছেন যে ফিশ্চুলার অন্যতম কারণ হল মলদ্বারে ইনফেকশন বা ফোঁড়া হওয়া। অনেকসময় ক্রনজ ডিজিস, টিউবারকিউলোসিস এবং ডাইভারটিকিউলাইটিস এর কারণেও ফিশ্চুলা হয়। 

এর উপসর্গ কি ?
# অসহনীয় একটানা ব্যথা হওয়া। বিশেষ করে বসার সময় অত্যন্ত অস্বস্তি হওয়া। 
# মলদ্বার ফুলে যাওয়া, চুলকানি হওয়া এবং লাল হয়ে যাওয়া। 
# পুঁজ বেরোনো ও রক্তক্ষরণ। 
# মলত্যাগে যন্ত্রনা ও কোষ্ঠকাঠিন্য।  
# জ্বর হওয়া। 

তাহলে ফিশ্চুলার চিকিৎসা কি ?
এর একমাত্র চিকিৎসা হল সার্জারি। তবে এটা অনেকটাই নির্ভর করবে মলদ্বারের ঠিক কোন জায়গায় ফিশ্চুলা হয়েছে তার ওপর। নিচে কিছু পদ্ধতি দেওয়া হল। 
# ফিশ্চুলোটমি  - ৯০% সময় এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। সম্পূর্ণ সেরে উঠতে এক -দু মাস সময় লাগে। 
# সিটন - এই পদ্ধতি একটি সার্জিক্যাল থ্রেডের মাধ্যমে করা হয়। অনেকসময় অন্য পদ্ধতি অবলম্বন করার আগে সিটন ব্যবহার করা হয়।
# ফিশ্চুলেক্টোমি - এই পদ্ধতিতে ফিশ্চুলা ট্রাক্ট কেটে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়। জটিল ফিশ্চুলার ক্ষেত্রে এই পদ্ধতিটিই শ্রেষ্ঠ চিকিৎসা। 
# লেজার ট্রিটমেন্ট - এই আধুনিক পদ্ধতিতে সার্জারির প্রয়োজন পড়ে না। এতে অন্যান্য পদ্ধতির তুলনায় সেরে উঠতেও কম সময় লাগে। 

এছাড়াও আরও পদ্ধতি আছে যা জটিল ফিশ্চুলার ক্ষেত্রে চিকিৎসকরা অবলম্বন করেন। 

সুতরাং এসমস্ত রোগ যদি আপনার হয়ে থাকে এবং আপনি যদি লজ্জা ও কুণ্ঠার ভেলায় ভেসে বেড়ান তাহলে কিন্তু হিতে বিপরীত হতে পারে। তাই কোনোরকম সঙ্কোচ না করে অবিলম্বে একজন ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া ভীষণ জরুরী। মনে রাখবেন এই সমস্ত রোগের প্রাথমিক চিকিৎসা হওয়াটাই আপনার পক্ষে অত্যন্ত মঙ্গলের। নাহলে ইনফেকশনের কবলে পড়ে শেষকালে কি মুখ আর 'ইয়ে' দুটোই খোয়াবেন নাকি ?

#piles #fissure #fistula #medicalarticles #genesishospitalkolkata #asprescribed

No comments:

Post a Comment