Saturday 6 January 2018

হাত জড়ালেই বন্ধু


আজকের দুপুরটা সম্পূর্ণ অন্য রকম। সারা বছরের মুহূর্তগুলো জমাট বাঁধা হয়ে আছে এক অমূল্য ক্ষণে। যে ক্ষণের অপেক্ষায় সৌভিক দিন গুনেছে সময়ের পর সময়ের হাত ধরে। অবশেষে পৃথা সায় দিয়েছে। সায় দিয়েছে কিছু মুহূর্ত একসাথে কাটাবার, কিছু উষ্ণতা একসাথে ভাগ করে নেবার। দুদিন আগে টেলিফোনে যখন সৌভিক ডায়াল করেছে পৃথার নাম্বারটা তখন পৃথা জানতই না সৌভিক তাকে দেখা করার কথা বলবে। জানত না গঙ্গার ধারে আপাত নিরিবিলি, ছিমছাম এক রেস্তরাঁর বুকে আঁকা হবে কত দিনবদলের স্বপ্ন। তাই আধঘন্টা আগেই পৌঁছে গিয়েছিল সৌভিক। পৃথা অবশ্য দেরি করেনি খুব বেশি। যথাসময় পৌঁছে টিউশন ক্লাসের ব্যাচমেট সৌভিকের চোখে চোখ রেখেছিল। ইশারায় জিজ্ঞেস করেছিল এমন তলবের কারণ। যদিও মনে মনে পৃথা জানত কারণটা, তবুও নিজের কানে শোনার লোভটুকু বিসর্জন দিতে পারেনি সে। পৃথার সমস্ত পছন্দসই খাবার অর্ডার করে অনুরাগের গল্পে মেতে উঠেছিল দুজনে। 

সবটাই নিজস্ব নিয়মে চলছিল। কিন্তু তীরে এসে যে তরী ডোবার উপক্রম হবে একথা বোধহয় একমাত্র ঈশ্বরই জানতেন। সৌভিক হয়ত একটু তাড়াহুড়ো করে ফেলেছিল। খাবার শেষ হওয়ার আগেই বলে ফেলেছিল তার হৃদয়ের গোপন আর্তিগুলো। অকপটে ছুঁয়ে ফেলেছিল ভালোবাসার স্পন্দন। অকস্মাৎ বিষম খেয়েছিল পৃথা। আর তাতেই কাল হল। মাংসের টুকরো গলায় আটকে দমবন্ধ হবার উপক্রম হল প্রায়। দুপুরের নৈকট্য টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে গেল জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষনে। দম আঁটকে অচৈতন্য হবার মুহূর্তে সৌভিক ধরে ফেলে পৃথাকে। বায়োলজির সুযোগ্য ছাত্র সৌভিক, হেমলিচ ম্যানুয়েভারের বিশেষ কায়দায় পৃথার পেটে চাপ দিয়ে গলা থেকে বের করে আনল মাংসের টুকরোটা। এক লহমা দম নিয়ে পৃথা জাপটে ধরেছিল সৌভিককে। আসন্ন মৃত্যুর কিনারা থেকে ফিরে এসে  থরথর করে কেঁপে উঠেছিল সে। সে যাত্রা জোর বেঁচেছিল পৃথা আর হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছিল রেস্তোরাঁর বাকি লোকজন। এই হেমলিচ ম্যানুয়েভারের বিশেষ কায়দাটি কি, সেটা আসুন একটু জেনে নিই।   

হেমলিচ ম্যানুয়েভার কি ?
হেমলিচ ম্যানুয়েভার হল একটি প্রাথমিক চিকিৎসা পদ্ধতি। শ্বাসনালীতে আটকে থাকা কোনো খাবারের টুকরো বা অন্য কোনো বস্তু বের করার ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়। ১৯৭৪ সালে ডঃ হেনরী হেমলিচ এই পদ্ধতিটি প্রথম প্রদর্শন করেন। ওনার নামানুসারেই এই পদ্ধতির প্রচলন শুরু হয়।জরুরী অবস্থায় এই পদ্ধতিটি কিভাবে প্রয়োগ করবেন তা জানতে হলে নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলি অনুসরণ করুন।


চোকড হবার সময় কি করবেন ?
যে ব্যক্তিটি চোকড হচ্ছেন তাঁর কথা বলা বা শ্বাস নেওয়ার ক্ষেত্রে ভীষণ সমস্যা হতে পারে। এই সময় যা করতে হবে তা হল -
# ব্যক্তিটির পিছন দিক দিয়ে কোমরের চারপাশে দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরুন।
# একহাতে মুঠো বন্ধ করে, আপনার বুড়ো আঙুলের দিকটা ব্যক্তিটির পাঁজরের নিচে অর্থাৎ পেটের ওপরের দিকে চেপে ধরুন।
# অন্য হাত দিয়ে সেই মুঠো চেপে ব্যক্তির পেটের উপরিভাগে জোরে চাপ দিন। কিন্তু খেয়াল রাখবেন এই চাপ যেন পাঁজরের ওপর কখনই না পড়ে।
# এই পদ্ধতিটি বারে বারে করতে থাকুন, যতক্ষণ না খাবারের টুকরো বা বস্তুটি মুখ দিয়ে বেরিয়ে না আসে।
# মনে রাখবেন কখনোই যেন পিঠে চাপড় মারবেন না। তাতে কিন্তু হিতে বিপরীত হতে পারে।


যখন ব্যক্তিটি অচৈতন্য হয়ে পড়েছেন তখন কি করবেন ?
# প্রথমে তাকে চিৎ করে শোয়ান। 
# এরপর ব্যক্তিটির কোমরের দু দিকে হাঁটু মুড়ে বসুন।
# একটা হাতের ওপর আরেকটা হাত রেখে ব্যক্তিটির পেটের ওপর দিকে অর্থাৎ পাঁজরের নিচে চেপে ধরুন।
# তারপর দুহাত একই ভাবে রেখে দ্রুত চাপ দিতে থাকুন।
# বস্তুটি বের না হওয়া পর্যন্ত একই ভাবে করতে থাকুন। এক্ষেত্রেও পিঠে চাপড় মারতে যাবেন না কিন্তু।


শিশুদের ক্ষেত্রে কি করবেন ?
# শিশুটিকে শক্ত জমির ওপর শুইয়ে দিন। অথবা নিজের কোলে নিয়েও বসাতে পারেন।
# আপনার দুহাতের তর্জনী ও মধ্যমা এক সাথে শিশুটির পাঁজরের নিচে এবং নাভির ওপর রাখুন।
# এরপর ওই অবস্থায় দুহাতের আঙ্গুল দিয়ে একসাথে পেটের উপরিভাগে চাপ দিতে থাকুন।
# বস্তুটি বের না হওয়া পর্যন্ত এই পদ্ধতি অনুসরণ করতে থাকুন।
# তবে খুব সাবধানে করবেন, পাঁজরে যেন কোনোভাবেই চাপ না পড়ে।

নিজের ক্ষেত্রে হলে কি করবেন ? 
# এক হাতে মুঠো বন্ধ করে, মুঠোর বুড়ো আঙুলের দিকটা আপনার পাঁজরের নিচে অর্থাৎ পেটের ওপরের দিকে চেপে ধরুন।
# তারপর অপর হাত দিয়ে সেই মুঠো চেপে পেটের উপরিভাগে জোরে চাপ দিন।
# বস্তুটি না বেরোনো অবধি এটি করতে থাকুন।
# এছাড়া আপনি কোনো চেয়ার, টেবিল বা শক্ত কিছুর ওপর ভর দিয়ে ঝুঁকে দাঁড়াতে পারেন।
# আপনার পেটের উপরিভাগ দিয়ে সেই শক্ত বস্তুটির ওপর ক্রমাগত চাপ দিতে থাকুন। এক্ষেত্রেও বস্তুটি শ্বাসনালী থেকে না বেরোনো অবধি বারে বারে করুন। 

ওপরের যে কোনো ক্ষেত্রে যদি পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হয় তাহলে অবিলম্বে ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করতে হবে এটি আর বলার অপেক্ষা রাখে না। উপরোক্ত ঘটনায় সৌভিক অনন্য গিফ্ট পেয়েছিল পৃথার থেকে। কারণ, এমন আশ্চর্য প্রাথমিক চিকিৎসা পদ্ধতিতে পৃথা শুধু মোহিতই হয়নি, তার বন্ধুর হাত ধরে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তার পরে পরেই। তবে জীবনবিজ্ঞানের ছাত্র বা ছাত্রী আপনি যদি নাও হন তবুও নিকট আত্মীয়ের বিপদের সময় হাত বাড়ানোটাই কিন্তু উপযুক্ত বন্ধুত্বের পরিচয়। হেমলিচ ম্যানুয়েভার পদ্ধতির সামান্য কয়েকটি ধাপ মাত্র, শিখে রাখতে ক্ষতি তো কিছু নেই, কে জানে কখন কোথায় কিভাবে কাজে লাগে, তাই না ? 

#Heimlichmaneuver #abdominalthrust #bengalihealtharticle #firstaid #emergencytreatment  #AsPrescribed

No comments:

Post a Comment