Tuesday 13 February 2018

তারাদের কথা


যে বিষয়ে নিয়ে একটা গোটা হিন্দী ছবি তৈরী হয়েছে, সেই বিষয়ের নাম আমাদের প্রায় সকলেরই জানা। কিন্তু শুধু জেনে রাখলেই কাজ শেষ হয় না, বরং সেখান থেকেই শুরু । ছবিতে ঈশান অবস্তির করুণ সময়ের কথা ভাবলেই আমাদের বুকের ভিতর মোচড় দিয়ে ওঠে। 'তুঝে সব হ্যায় পাতা....মেরি মা' এই গান শুনলে আজও চোখের পাতা ভারী হয়ে আসে, একথা সত্যি, কিন্তু বিশ্বাস করুন, ব্যাস ! ওই পর্যন্তই। পরবর্তী সময়ের সংগ্রাম ও নিরলস পরিশ্রমের কথা আমরা ভাবতেও পারি না, তার কারণ আমরা একটা গল্প তৈরী হতে দেখেছি, চেষ্টা করেছি সে গল্পের সাথে বাঁচতে কিন্তু ব্যক্তিগত ভাবে অনুভব করিনি। আমাদের বাড়িতে যদি এমনই একজন ডিস্লেক্সিক শিশু থাকত তাহলে কিন্তু সমস্যাটা আর রুপালি পর্দার মোড়কে বন্দী হয়ে থাকত না। দৈনন্দিন জীবনে তার প্রভাব বোধহয় পাহাড়ের থেকেও ভারী মনে হত তখন। কঠিন হলেও এমন সমস্যার সম্মুখীন হওয়ার কি কি উপায় আছে আসুন একটু দেখে নিই।     

ডিস্লেক্সিয়া কি ?
ডিস্লেক্সিক একটি গ্রীক শব্দ যার অর্থ হল শব্দের সমস্যা। এর নানা রকম সংজ্ঞা থাকতে পারে, তবে  সহজ ভাষায় ডিস্লেক্সিয়া হল একপ্রকার অক্ষমতা যার দরুন পড়তে, লিখতে বা বুঝতে সমস্যা হয়। জেনে রাখা ভালো যে এই সমস্যাটি কিন্তু সম্পূর্ণ ভাষাগত এবং এর সাথে বুদ্ধিমত্তার কোনো সম্পর্ক নেই। সুতরাং বাড়িতে যদি ডিস্লেক্সিক শিশু থাকে তাহলে তার মেধা নিয়ে আশঙ্কিত হবার কোনো প্রয়োজন নেই। দেখা গেছে শিশুরা ডিস্লেক্সিক হলেও অন্যান্য বিষয়ে তারা বেশ প্রতিভাশালী হয়। এমন চমকপ্রদ উদাহরণ বহু আছে। তবে তার আগে জেনে নিই ঠিক কি কারণে ডিস্লেক্সিয়া হয়। 

কি কারণ ?
ডিস্লেক্সিয়া এসোসিয়েশন অফ ইন্ডিয়ার এক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে ভারতবর্ষে প্রায় ১০ থেকে ১৫ শতাংশ স্কুল পড়ুয়া শিশুরা কোনো না কোনো ভাবে ডিস্লেক্সিয়ায় আক্রান্ত। আমাদের দেশের বহুভাষার সমস্যাও কিন্তু এর অন্যতম কারণ হতে পারে। সাধারণত ডিস্লেক্সিয়ার সঠিক কারণ চিহ্নিত করা যায় নি, তবু কিছু তথ্যের ফলে একটা সম্যক ধারণা তৈরী করা যায়। যেমন - আমরা জানি যে একজন বাঁহাতির ক্ষেত্রে ডানদিকের মস্তিস্ক বেশি সক্রিয় এবং একজন ডানহাতির ক্ষেত্রে মস্তিষ্কের বাঁদিক। কিন্তু একজন ডিস্লেক্সিকের ক্ষেত্রে মস্তিষ্কের কোন দিকটি বেশি সক্রিয় তা নিয়ে বিভ্রান্তির ফলে তথ্যের সরলীকরণে সমস্যা হয়। এছাড়া জিনগত বা পরিবেশগত কারণেও ডিস্লেক্সিয়া হতে পারে। তাহলে কিভাবে বুঝবেন একটি শিশু ডিস্লেক্সিক ? আসুন জেনে নিই। 

উপসর্গ কি ?
# পড়বার সময়ে সমস্যা  
# ডিস্লেক্সিক শিশুদের তুলনামূলক ভাবে সাধারণ কাজে দেরি হয় বেশি - যেমন হাঁটাচলা, কথা বলা, সাইকেল চড়া ইত্যাদি 
# ভুল উচ্চারণ করা, ছড়া বলায় সমস্যা এবং শব্দের তফাৎ করতে না পারা 
# অক্ষর ও তার উচ্চারণে বিলম্ব হওয়া, রঙ চিনতে সমস্যা হওয়া বা গণিতে অসুবিধা 
# সাধারণ খেলাধুলায় সমস্যা 
# ডানদিক - বাঁদিক গুলিয়ে ফেলা 
# অক্ষর বা সংখ্যা উল্টো করে লেখা এবং বানানে সমস্যা 
# কোনো কাজে মনোযোগী না হওয়া
# ডিস্লেক্সিক শিশুরা এমনভাবে পরপর তাদের ভাবনাগুলিকে ব্যক্ত করে যা অযৌক্তিক বা অপ্রয়োজনীয়ও মনে হতে পারে
# এছাড়া এজমা, এক্জিমা বা অন্য ধরণের এলার্জিও হয়ে থাকে ডিস্লেক্সিক শিশুদের 

এ সমস্যার সমাধান কি ?
এই ধরণের সমস্যা অবহেলা করা একেবারেই উচিত নয়। বরং বাবা মায়েদের আরেকটু বেশি যত্নবান হতে হবে, তাহলেই সমস্যাগুলি সহজে ধরা পড়বে।

# প্রথমেই ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে শুরু করুন। তাহলে শিশুটির পক্ষে সমস্ত কিছু বুঝতে অনেকটাই সহজ হবে। কোনোভাবেই ধৈর্য হারানো চলবে না।  

# ডিস্লেক্সিক শিশুদের সাধারণত জানার ইচ্ছে প্রবল হয়। যুক্তিসম্মত উত্তর পেলে শিখতে দেরি হয় না তাদের। লেখার ওপর জোর দিন বেশি, শুধুমাত্র কানে শুনে শিখে ফেলা কঠিন কিন্তু। 

# বিজ্ঞানের বিষয়গুলি টেবিল বা চার্টের মাধ্যমে বোঝান। এতে সহজ হবে অনেকটাই।

# অডিও ভিজ্যুয়াল পদ্ধতিতে বেশ সুফল পাওয়া যায়। যে কোনো বিষয় চিত্রের মাধ্যমে বোঝালে মনে রাখতে সুবিধে হবে। 

#  বিজ্ঞান সম্মত পদ্ধতিতে স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধির ওপর জোর দিন। যেমন - একটা প্যারাগ্রাফ পড়ানোর পর বিভিন্ন ভাবে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে প্রশ্ন করুন। এতে ভালো কাজ দেয়। 
# ফ্ল্যাশ কার্ডের সাহায্যে শেখালে ভালো হয়। নির্দিষ্ট সময়ের পরপর পুনরায় চেষ্টা করুন। 

# বস্তুর আকৃতি ও আয়তন সঠিক ভাবে বুঝিয়ে দিন। যেমন - বৃত্ত ও গোলকের তফাৎ বুঝিয়ে দিন সুনির্দিষ্ট ভাবে। জ্যামিতিক আকারগুলি ভালো করে বোঝানো প্রয়োজন। 

# নিয়মিত যোগাসন মনোযোগ বাড়াতে সাহায্য করে। শিশুদের অভ্যেস করান, সুফল পাবেন।

# স্কুলের শিক্ষক বা শিক্ষিকাদের সাথে আলোচনা করে বিশিষ্ট চিকিৎসকদের নিয়ে এই বিষয়ের ওপর সেমিনার করতে পারেন। এতে দু পক্ষই উপকৃত হবে।

# ডিস্লেক্সিক শিশুদের চিহ্নিত করার কিছু টেস্ট আছে। এই লিংকটি ক্লিক করে জেনে নিন আপনার বা আপনার পরিচিত কোনো শিশু ডিস্লেক্সিক নয়তো ! https://www.lexercise.com/tests/dyslexia-test
উপরন্তু কলকাতার বুকে একটি সংস্থা আছে যাঁরা ডিস্লেক্সিক শিশুদের অত্যন্ত যত্ন নিয়ে শেখান। তাঁদের ওয়েবসাইটের লিংক দেওয়া হল -  http://www.breakingthroughdyslexia.com/index.php
এছাড়া কলকাতায় এমন অনেক স্কুল আছে যেখানে অন্যান্য শিশুদের সাথেই ডিস্লেক্সিক শিশুদের ট্রেনিং দেওয়া হয়। 

ঈশান অবস্তি গল্পের চরিত্র হলেও বাস্তবিক এমন অনেকেই আছেন যাঁরা ডিস্লেক্সিক হয়েও পরবর্তী জীবনে সাফল্যের উচ্চতায় পৌঁছেছেন। উদাহরণস্বরূপ যাঁদের নাম বলছি তাঁরা অতীব জনপ্রিয় শুধু নন, স্ববিভাগে নির্দিষ্ট ছাপ রেখে গেছেন। তাঁরা দেখিয়ে গেছেন প্রতিভা গোপন থাকে না, সঠিক সময় নিজ গুণবলে নক্ষত্রের মত উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। তাঁরা হলেন - এলবার্ট আইনস্টাইন, পাবলো পিকাসো, লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি, জর্জ ওয়াশিংটন, জন এফ কেনেডি, ওয়াল্ট ডিজনি, জন লেনন, রিচার্ড ব্র্যানসন, স্টিভেন স্পিলবার্গ, টম ক্রুজ, জিম ক্যারি এবং আরও অনেক বিখ্যাতরা যাঁদের নাম বলতে গেলে এই লেখা হয়ত কোনোদিন শেষ হবে না। 

সুতরাং আপনার বাড়িতে যদি একজন ডিস্লেক্সিক শিশু থাকে তাহলে ভেঙে না পড়ে তার প্রতিভার দিকে নজর দিন। কে জানে হয়ত কোনো একদিন তারই কৃতিত্বে আপনি গর্বিত হবেন। আপনার মতো করে নয়, ওদের চোখ দিয়ে পৃথিবীটা দেখতে শিখুন, কতকটা ওদের মতো করেই বাঁচুন, এ পৃথিবী অনেক নিষ্পাপ ও আলোকজ্জ্বল মনে হবে, আমি একশোভাগ নিশ্চিত।

#Dyslexia #DyslexiaAssociationofIndia #Learningdisability #Learningdisorder #Medicalarticle #GenesisHospitalKolkata #AsPrescribed 

No comments:

Post a Comment