Tuesday, 7 August 2018

কানভারী


বর্ষার বিকেল। বৃদ্ধ অখিলেশ তার ছোট্ট ঘরে একটা তক্তপোশের ওপর বাবু হয়ে বসে আছেন। মুখে চোখে চিন্তার ছাপ। আদ্যিকালের সিলিং ফ্যানের ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ ছাড়া আর কিছুই শোনা যায় না প্রায়। উল্টোদিকের চেয়ারে গম্ভীরমুখে বসে আছেন অখিলেশের উকিল। খানিক্ষন চুপ করে একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উকিল ভদ্রলোকটি মুখ ফুটে বললেন, 'আপনি কিন্তু আরেকবার ভেবে দেখতে পারতেন.....মানে এই নিয়ে চারবার হল কিনা'। দুদিকে মাথা নাড়িয়ে বিরসবদনে অখিলেশ বললেন, 'না হে সুকান্ত, চারবার যখন করেছি তখন পাঁচবারে কোনো ক্ষতি নেই। এই সম্পত্তি আমি দান করে দেব, আমার আর কোনো মোহ নেই'। 

এখানে নেপথ্যের গল্পটা জানা দরকার সকলের, তাহলেই গোটা ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে। অখিলেশ গত কয়েক বছর ধরে ভীষণ কানের সমস্যায় ভুগছিলেন। অবস্থা এমন পর্যায় গিয়ে দাঁড়ায় যে শেষটায় প্রায় বধির হওয়ার জোগাড় হয়েছিল। চুপচাপ একজন ই.এন.টি বিশেষজ্ঞকে দেখিয়ে তিনি হিয়ারিং এড ব্যবহার করতে শুরু করেন। কিন্তু তাতে করে আরও কাল হয়। চোরাগোপ্তা নিজের ছেলেমেয়েদের যে কথোপকথন তিনি শুনতে পেয়েছিলেন তাতে বাধ্য হয়ে চারবার উইল চেঞ্জ করতে হয়েছিল তাঁকে। শেষটায় সিদ্ধান্ত নিলেন তাঁর সম্পত্তি কোনো ছেলেমেয়েকে না দিয়ে সম্পূর্ণ দান করে দেবেন এক বৃদ্ধাশ্রমে। আর ঠিক সেই কারণেই আজ উকিলবাবুর আগমন। সুতরাং বধির হলেই যে সমস্যা হয় তা কিন্তু নয়, পুনরায় শ্রবণশক্তি ফিরে পাওয়ারও গ্যাঁড়াকল আছে কিছুটা। তবে গল্পের মজা থেকে সরে এসে বলব সর্বক্ষেত্রে কিন্তু সুস্থ জীবনই কাম্য। 

এই সূত্রে জানাই যে বধিরতার কিছু প্রকারভেদ আছে এবং প্রত্যেক ভেদের সমস্যা কিন্তু ভিন্ন। সুতরাং কোন ধরণের বধিরতা সেটা প্রথমেই জানা থাকলে তার চিকিৎসায় সুবিধে হয়। এক এক করে বলি। 

১. অডিটরি প্রসেসিং ডিসর্ডার (APD) - দেখা গেছে প্রায় ৫% স্কুল পড়ুয়া শিশুরা এই রোগে আক্রান্ত। এই সমস্যায় কান আর মস্তিস্কের কোনো সমন্বয় ঘটে না। যার ফলে শুনতে বা বুঝতে যথেষ্ট সমস্যা হয়। এক্ষেত্রে শিশুটি, শব্দ বা ধ্বনির তারতম্য ধরতে পারে না। আরও অসুবিধে হয় যখন শিশুটি কোনো শব্দবহুল পরিবেশে থাকে যেমন  - খেলার মাঠ, সামাজিক অনুষ্ঠান বা গানের অনুষ্ঠান ইত্যাদি। তবে চিন্তার কিছু নেই। সঠিক চিকিৎসা বা থেরাপির মাধ্যমে সুস্থ হয়ে ওঠার সম্ভাবনা  অনেকটাই প্রবল। প্রয়োজন শুধু আগাম রোগ নির্ণয়, তা না হলে পরবর্তীকালে ভাষা ও কথা বলায় বিস্তর সমস্যা হতে পারে। এছাড়া ডেফ মিউটিজমের কারণেও APD হতে পারে। জন্মগত ভাবে যদি কেউ বধির হয় তাহলে সে জন্মগত ভাবে মূকও হয়। তার কারণ কথা বলার অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলি ঠিক থাকলেও শব্দ না শুনতে পাওয়ার ফলে সে কোনো শব্দই তৈরী করতে পারে না।

২. কন্ডাক্টিভ হিয়ারিং লস - যখন কানের বহির্ভাগ এবং মধ্যভাগে শব্দ পৌঁছতে পারে না তখনই  কন্ডাক্টিভ হিয়ারিং লস হয়। এক্ষেত্রে মৃদু শব্দ একেবারেই শোনা যায় না এবং জোরে শব্দ হলে জড়িয়ে যায়। বেশ কিছু কারণে এই সমস্যা হয়। যেমন - 


# ঠান্ডা বা এলার্জি থেকে কানের মধ্যে তরল জমতে পারে
# কানের সংক্রমণ
# ইউস্টাশিয়ান টিউবের সঠিক ভাবে কাজ করতে না পারা
# কানের পর্দায় ফুঁটো
# টিউমার, যা কানের বহির্ভাগ এবং মধ্যভাগ আটকে দিতে পারে # কানের মধ্যে প্রচুর ময়লা জমা হওয়া  
# কানের মধ্যে কোনো কিছু আটকে থাকা
# কানের অভ্যন্তরীণ গঠনে সমস্যা

তবে ঘাবড়ে যাওয়ার কিছু নেই। এমনটা হলে কিছু ওষুধ বা অস্ত্রোপচারের সাহায্যে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব।

৩. সেন্সরিনিউরাল হিয়ারিং লস - কানের অভ্যন্তরীণ অংশ বা ককলিয়ায় চুলের মতো সরু সরু কিছু কোষ থাকে যা সময়ের সাথে সাথে কমে যায়। ফলস্বরূপ, যত বয়স বাড়ে তত শ্রবণশক্তি হ্রাস পায়। চিকিৎশাস্ত্রে একে বলা হয় প্রেসবাইকিউসিস (Presbycusis) তবে শুধুমাত্র এটাই কারণ নয়। অতিরিক্ত শব্দের কারণেও এই কোষগুলি নষ্ট হতে পারে। যেমন কাজের সূত্রে শব্দপ্রবণ পরিবেশে সময় কাটানো বা অনেক্ষন ধরে ভীষণ জোরে গান শোনা ইত্যাদি। এছাড়া মাম্পস, মেনিঞ্জাইটিস, স্কলেরোসিসের মতো রোগ হলেও সেন্সরিনিউরাল হিয়ারিং লস হতে পারে। জেনে রাখুন কিছু ওষুধ বা এন্টিবায়োটিকের কারণেও এমনটা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাছাড়া মাথায় বা কানে সাংঘাতিক চোট লাগলেও শ্রবণক্ষমতা লোপ পেতে পারে। এর একমাত্র চিকিৎসা হল সেন্সরিনিউরাল হিয়ারিং এড অথবা অস্ত্রপচার যার দরুন এই সমস্যা আংশিকভাবে ঠিক হওয়া সম্ভব। এছাড়া একুয়াস্টিক নিউরোমা নামে একটি রোগের কারণেও এই হিয়ারিং লস হতে পারে। মস্তিষ্কের এক বিশেষ স্নায়ুতে টিউমার হওয়ার ফলে কানের এই সমস্যাটি হয়।

৪. মিক্সড হিয়ারিং লস - মিক্সড হিয়ারিং লস হল কন্ডাক্টিভ এবং সেন্সরিনিউরাল সমস্যার সমষ্টি বিশেষ। এর অর্থ হল কানের বহির্ভাগ, মধ্যভাগ এবং অভ্যন্তরীণ অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এক্ষেত্রে শ্রবণশক্তি হ্রাসের পরিমাণ অল্প থেকে বেশিও হতে পারে। এর কারণগুলি হল কন্ডাক্টিভ এবং  সেন্সরিনিউরাল কারণের মতোই। এর চিকিৎসা নির্ভর করে সমস্যার গভীরতার ওপর। অর্থাৎ ওষুধ বা হিয়ারিং এড ব্যবহার করে কাজ হতে পারে আবার প্রয়োজন হলে অস্ত্রোপচার বা বোন কন্ডাকশন ইম্প্ল্যান্টও করতে হতে পারে।

এর চিকিৎসা আছে নাকি চিরকাল কালা হয়েই থাকতে হবে ?
অত্যাধুনিক পদ্ধতিতে বধির হয়ে থাকার দিন শেষ। বিভিন্ন পদ্ধতি আছে যার প্রচেষ্টায় আবার আপনার হৃতগৌরব ফিরে আসতে পারে। সেই সমস্ত পদ্ধতি নিয়ে নিচে বিস্তারিত আলোচনা করা হল।

# কান পরিষ্কার - একজন ই.এন.টি চিকিৎসক অত্যন্ত সাবধানে এই কাজটি করে থাকেন। তেল ব্যবহার করে এবং ইরিগেটর যন্ত্রের সাহায্যে কানের সমস্ত ময়লা ধুয়ে বা টেনে বের করে আনা হয়।

# অস্ত্রোপচার - কানে যদি সাংঘাতিক আঘাত লাগে বা কোনোরকম সংক্রমণ হয় তাহলে অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হয়।

# হিয়ারিং এড - কানের অভ্যন্তরীণ ভাগের সমস্যার কারণে যদি শ্রবণক্ষমতা লোপ পায় তাহলে    
সেক্ষেত্রে হিয়ারিং এডের কার্যকারিতা অনস্বীকার্য। তবে অবশ্যই একজন ই.এন.টি চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে কাজ করা উচিত।
# ককলিয়ার ইমপ্ল্যান্ট - যদি আপনার শ্রবণশক্তি একেবারেই লুপ্ত হয়ে থাকে, তাহলে ককলিয়ার ইমপ্লান্ট আপনার জন্য দারুন একটি বিকল্প হতে পারে কারণ এটি হিয়ারিং এডের থেকেও উন্নত। ককলিয়ার ইমপ্ল্যান্ট হল একটি ইলেক্ট্রনিক চিকিৎসা যন্ত্র যা একটি ক্ষতিগ্রস্ত কানের অভ্যন্তরীণ অংশের কাজ করে। এই ইমপ্ল্যান্টটি মস্তিষ্কে শব্দের সিগন্যাল পাঠাতে সাহায্য করে। একটি ছোট্ট সার্জারির মাধ্যমে এটি বসিয়ে দেওয়া হয় কানের ভিতরের দিকে। এই সম্বন্ধে বিস্তারিত জানতে নিচের লিংক ক্লিক করুন -
https://docs.wixstatic.com/ugd/c72522_2135963da147417890acabb3a63dc6df.pdf


সুতরাং, এবার কিন্তু আপনাকে আর চোখ মুখ কুঁচকে, কানের পাশে হাত রেখে, উল্টোদিকের মানুষের মুখের ওপর ঝুলে পড়তে হবে না। বা হাসিহাসি মুখে তার ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে বুঝতে হবে না তিনি  সিঙ্গাপুর বলছেন নাকি শ্রীরামপুর বোঝাচ্ছেন। কানের সমস্যা যেমনই হোক না কেন, তার যে একটা বাস্তবিক চিকিৎসা আছে তা কিন্তু ওপরের লেখা থেকেই পরিষ্কার। এখন আপনি আপনার অনুমান ক্ষমতার ওপর ভরসা করবেন নাকি একবার কানের চিকিৎসা করিয়ে নেবেন সে সিদ্ধান্ত একান্তই আপনার। শুধু এটুকু বলতে পারি জেনেসিস হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ই.এন.টি বিভাগ এই বিষয়ে যেকোনো জটিল সমস্যার সমাধানে সক্ষম। যোগাযোগের নম্বর - ২৪৪২ ৪২৪২ / ৪০২২ ৪২৪২। 

সবশেষে একটা আশ্চর্য তথ্য দিই। শিশুরা কিন্তু প্রথম শুনতে শুরু করে গর্ভে থাকাকালীন ২৩ থেকে ২৭ সপ্তাহের মধ্যে। শুধু তাই নয়, মায়ের গলার স্বর এবং অন্যান্য শব্দও আলাদা করে তারা চিনতে  পারে। তাই গর্ভাবস্থায় আপনার শিশুকে বিশেষ কোনো সঙ্গীত বা শব্দ যদি নিয়মিত শোনাতে পারেন তাহলে জন্মের পর তাকে সামলানো সহজ হবে। 


#deafness #hearingloss #ENT #medicalarticle #bengalihealtharticle #AsPrescribed #GenesisHospitalKolkata

No comments:

Post a Comment