কিছু কিছু বিষয় প্রায় অধিকাংশ সময় পর্দার আড়ালে বা মাদুরের নিচে চাপা পড়ে থাকে। ধুলো ঝাড়ার মতো করে ঝেড়ে নিয়ে তাকে সর্বসমক্ষে নিয়ে আসার দুঃসাহস আমরা সচরাচর দেখাতে পছন্দ করি না। বিশেষ করে সে বিষয় যদি মহিলা কেন্দ্রিক হয় তাহলে তো আলোচনা করা দূর, সে প্রসঙ্গের ছায়া পর্যন্ত মাড়াই না। অথচ যখন বিপদে পড়ি তখন কিন্তু ছোট্ট ছোট্ট পায়ে চলতে চলতে ঠিক ডাক্তারের কাছে উপস্থিত হয়ে সমস্তটা খোলসা করে বলি। তেমনই একটা বিষয় হল মেনোপজ বা ঋতুবন্ধ।
তবে এ সমস্যা আজকের নয়। জানলে হাঁ হয়ে যাবেন, ১৮০০ শতাব্দীতে কিছু পাশ্চাত্য দেশে মহিলাদের মেনোপজ বা ঋতুবন্ধ হলে বলা হত, তাদের 'মৃত্যুর দরজা' বা 'gateway to death' উন্মুক্ত হল। মেনোপজ আটকাতে গিনিপিগের ডিম্বাশয় থেকে জ্যুস বানিয়ে খেতেও দ্বিধা বোধ করতেন না সেই সময়ের মহিলারা। অবশ্য ভারতবর্ষে এমন কোনো ঘটনা ঘটত কিনা সেটা জানা নেই। তবে রক্ষণশীল দেশ হিসেবে এই বিষয়ে যে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করা যেত না সে ব্যাপারে আমরা একশোভাগ নিশ্চিত। বর্তমান যুগে সে সমস্যা খানিক মিটেছে বটে কিন্তু এহেন মোক্ষম বিষয় গোপন রাখতে আমরা কিন্তু এখনো ভালোবাসি। অনেকেরই হয়ত জানা নেই যে এই ধরণের বিষয়গুলি সঠিক জানা না থাকলে পরবর্তীকালে জটিল হবার সম্ভাবনা থাকে দ্বিগুন। তারচেয়ে আসুন সমস্যাগুলি রাখঢাক না করে খোলাখুলি আলোচনা করে নিই।
মেনোপজ কি ?
মেনোপজ বা ঋতুবন্ধ এমন একটি শারীরিক প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে একজন মহিলার ঋতুস্রাব বন্ধ হয়। মহিলাদের জীবনে এটি একটি অত্যন্ত সাধারণ ঘটনা এবং জেনে রাখা ভালো যে এটি কিন্তু কোনোরকম রোগ বা ব্যাধি নয়। টানা বারো মাস যদি ঋতুস্রাব বন্ধ থাকে তাহলে বলা হয় সেই মহিলার ঋতুবন্ধ হয়েছে। সাধারণত ৫০ বছর বয়েসের পরেই ঋতুবন্ধ হয়ে থাকে তবে ৪০ থেকে ৫০ বছর বয়েসের যে কোনো সময়ের মধ্যেও এটা ঘটতে পারে।
মেনোপজ হওয়ার কারণ
# বয়স বাড়ার সাথে সাথে অর্থাৎ ৪০ এর কোঠায় ঢোকার মুহূর্তে একজন মহিলার শরীরে প্রজনন হরমোনের মাত্রা কমতে থাকে। কারণ, ডিম্বাশয়ের মধ্যে ইস্ট্রোজেন এবং প্রোজেস্টেরনের উৎপাদন অনেকটাই হ্রাস পায় । যার ফলে মাসিকের সময়কালে হেরফের ঘটে এবং ৫০ বা ৫১ বছর বয়েসের পরই তা সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়।
# হিস্টেরেক্টমি এবং বাইল্যাটারাল উফরেক্টমির মাধ্যমে যদি জরায়ু এবং ডিম্বাশয় কেটে বাদ দিয়ে দেওয়া হয় তাহলে তাৎক্ষণিক ঋতুবন্ধ হবে। স্বাভাবিকভাবে মাসিকও বন্ধ হয়ে যাবে এবং ঋতুবন্ধের উপসর্গগুলিও দেখা দেবে।
# কেমোথেরাপি এবং রেডিয়েশন থেরাপিও ঋতুবন্ধের অন্যতম কারণ হতে পারে। তবে সর্বক্ষেত্রে থেরাপির পর একেবারে মাসিক বন্ধ হয়ে যায় না।
# প্রাথমিক অপর্যাপ্ত ডিম্বাশয় - দেখা গেছে প্রায় এক শতাংশ মহিলাদের ক্ষেত্রে ৪০ বছর বয়েসের আগেই ঋতুবন্ধ ঘটে। একে অকাল ঋতুবন্ধ বা প্রিমাচিওর মেনোপজ বলা হয়। এর কারণ হল ডিম্বাশয়ের মধ্যে উপযুক্ত পরিমানে প্রজনন হরমোন তৈরী না হওয়া। সাধারণত এর কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া যায় নি তবে চিকিৎসকদের মতে এক্ষেত্রে হরমোন থেরাপি করিয়ে নেওয়াটা ভীষণ জরুরি, এতে মস্তিস্ক, হৃদয় এবং হাড় সুরক্ষিত থাকে।
উপসর্গ
ঋতুবন্ধ হওয়ার আগে অর্থাৎ পেরিমেনোপজের মুহূর্তগুলিতে বেশ কিছু শারীরিক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। যদিও সমস্ত মহিলাদের ক্ষেত্রে একইরকম হবে এমনটা নয় তবু সাধারণত যে উপসর্গগুলি দেখা যায় তা হল -
# অনিয়মিত মাসিক - হঠাৎ বন্ধ হয়ে গিয়ে আবার কয়েক মাস বাদে শুরু হতে পারে
# যোনিতে শুষ্ক ভাব
# হট ফ্ল্যাশ - শরীরের উপরিভাগে অর্থাৎ মুখ, গলা বা বুকের অংশে গরম ভাব
# নাইট সোয়েট - রাত্রে ঘুমোবার সময় হট ফ্ল্যাশ হওয়া
# ঘুমোনোয় সমস্যা
# মেজাজে পরিবর্তন
# ওজন বৃদ্ধি এবং হজমে সমস্যা
# পাতলা চুল, শুষ্ক ত্মক এবং
# স্তন সংকোচন হওয়া
জটিলতা
তবে এ পর্যন্ত যা আলোচনা করা হল, তা পড়ে অনেকেই হয়ত নাক সিঁটকোচ্ছেন আর ভাবছেন, ধুস ! এ আর নতুন কি ? এর অধিকাংশই তো জানা এবং সিলেবাসের মধ্যেই। তাহলে আপনাদের বলি যে অতটাও উদাসীন হবেন না। কারণ কিছু কিছু বিষয় আছে যা সিলেবাসের বাইরে এবং যথেষ্ট বেগ দিতে পারে এই সময়টায়। ঋতুবন্ধের কারণে বেশ কিছু জটিলতা তৈরী হয় এবং সময় বিশেষে তা মারাত্মক হতে পারে যদি না আগের থেকেই সাবধান হওয়া যায়। যেমন -
# হৃদরোগ - ইস্ট্রোজেনের মাত্রা হ্রাস পাওয়ার সাথে সাথে হৃদরোগের সমস্যা তৈরী হওয়ার ঝুঁকি থেকে যায়।
# অষ্টিওপোরোসিস - ঋতুবন্ধের প্রথম কয়েক বছরের মধ্যেই মহিলাদের হাড়ের ঘনত্ব কমে আসে। এর ফলে অষ্টিওপোরোসিস হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকে।
# প্রস্রাবে অসংযম - ঋতুবন্ধের কারণে যোনি এবং মূত্রনালীর টিস্যুর ক্ষমতা কমে আসে। এর ফলে যখন তখন প্রস্রাব পাবার সম্ভাবনা তৈরী হয়। কখনো কখনো অনিচ্ছাকৃত ভাবেও প্রস্রাব হয়ে যায়। বিশেষ করে, হাঁচি, কাশি বা অত্যধিক হাসলেও এমনটা হতে পারে।
# স্তনের ক্যান্সার - ঋতুবন্ধের পর এই রোগ হতে পারে। তবে নিয়মিত শরীরচর্চা করলে ঝুঁকি কম থাকে।
# যৌনতা হ্রাস - শুষ্ক যোনির কারণে যৌনমিলনে অস্বস্তি বা সামান্য রক্তপাত হতে পারে। যার ফলে যৌনমিলনে প্রবল অনিচ্ছা তৈরী হতে পারে। এক্ষেত্রে ময়েশ্চারাইজার বা লুব্রিক্যান্ট ব্যবহার করা যেতে পারে।
# ওজন বৃদ্ধি - ঋতুবন্ধের পর, অধিকাংশ ক্ষেত্রে মহিলাদের ওজন বেড়ে যায় তার কারণ এই সময় পাকপ্রক্রিয়া ধীরগতির হয়। সেক্ষেত্রে একটু কম পরিমাণে খেতে হবে এবং নিয়মিত শরীরচর্চা করতে হবে যাতে ওজনটা একই থাকে।
চিকিৎসা
ঋতুবন্ধে তেমন কোনো চিকিৎসার প্রয়োজন পড়ে না। তবে বয়স বাড়ার সাথে সাথে যদি কোনো উপসর্গে সমস্যা দেখা দেয় তাহলে একজন দক্ষ চিকিৎসকের থেকে পরামর্শ নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। এছাড়া নিম্নলিখিত কিছু পদ্ধতি আপনাকে স্বস্তি দিতে পারে।
# হরমোন থেরাপি - হট ফ্ল্যাশ উপশমের জন্য ইস্ট্রোজেন থেরাপির বিশেষ কার্যকরী ভূমিকা আছে। যদি জরায়ু থাকে তাহলে ইস্ট্রোজেনের সাথে প্রোজেস্টিনেরও প্রয়োজন আছে। ইস্ট্রোজেন হাড়ের ক্ষয় প্রতিরোধ করে। তবে পুরোটাই নির্ভর করবে একজন মহিলার শারীরিক অবস্থা বা তার চিকিৎসকের পরামর্শের ওপর।
# ভ্যাজাইনাল ইস্ট্রোজেন - এটি একটি ক্রীম, ট্যাবলেট বা রিঙের সাহায্যে যোনির শুষ্ক ভাব বা অস্বস্তি দূর করতে সাহায্য করে। এতে মূত্র সম্পর্কিত বাকি উপসর্গগুলি থেকেও উপশম ঘটে।
# লো ডোজ এন্টিডিপ্রেস্যান্ট - হট ফ্ল্যাশ বা মেজাজ পরিবর্তনে এই এন্টিডিপ্রেস্যান্ট থেকে সুফল পাওয়া যায়।
# গাবাপেন্টিন (নিউরোন্টিন, গ্রেলাইজ এবং অন্যান্য) - যারা ইস্ট্রোজেন থেরাপি নিতে পারেন না এবং রাতের পর রাত হট ফ্যাশের সমস্যায় ভোগেন তাদের জন্য এই ওষুধ বেশ স্বস্তিদায়ক।
# ক্লোনিডিন - উচ্চ রক্তচাপ বা হট ফ্ল্যাশের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয় এই ওষুধ।
# অষ্টিওপোরোসিসের ওষুধ - এই ক্ষেত্রে একজন দক্ষ অর্থোপেডিকের পরামর্শ খুব জরুরি। এছাড়া নিয়মিত ভিটামিন ডি সাপ্লিমেন্টে নিলেও হাড় শক্ত হবে।
ঋতুবন্ধ অত্যন্ত সহজ সাধারণ হলেও এর উপসর্গ বা পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া অনেক সময়ই চিন্তার কারণ হয়ে ওঠে। এসমস্ত ক্ষেত্রে অবস্থা জটিলতর হলে ঝঞ্ঝাটের শেষ থাকে না। যদিও এই অবস্থা বাস্তবে এড়ানো সম্ভব নয় তবু এর উপসর্গ থেকে অন্তত কিছুটা হলেও উপশম পাওয়া যায়, যদি উপরোক্ত বিষয়ের ওপর মনোযোগী হন তবেই। তাই আপনার বয়স যদি ৪০ পেরিয়ে গিয়ে থাকে তাহলে বলব নিজের শরীরের প্রতি আরেকটু যত্ন নিন। কালের গর্ভে কি অপেক্ষা করে আছে আমাদের জন্য আমরা কেউই জানি না। তার চেয়ে আগের থেকেই সাবধান হই বরং, কি বলেন ?
#medicalarticle #healtharticle #menopause #hotflash #nightsweat #oldageproblems #GenesisHospitalKolkata #AsPrescribed
No comments:
Post a Comment